জোছনাপ্রভা
জোছনাপ্রভা (ছোটগল্প)
এপ্রিলের মাঝামাঝি। সাধারণত এই সময়টাতে যেরকম গরম পড়ে এবার সেরকম গরম পড়েনি। তবুও উঠোনের কোনাটায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে রফিকুল। বাড়ির পাশের ছোট্ট বাগান থেকে হাস্নাহেনার কড়া ঘ্রাণ আসছে। এত কড়া ঘ্রাণ সাধারণত সহ্য করতে পারে না সে। সাইনাসে সমস্যা থাকার কারণে মাথাব্যথা ধরে যায়। আজ অবশ্য তেমন কিছুই হচ্ছে না। ভেতরের ঘরে মৃদু কলরব। ওইদিকেই মনোযোগ তার। রাত কটা হলো কে জানে! অনেক্ষণ আগেই কে যেন একটা চেয়ার পেতে দিয়ে গেছে। কিন্তু বসার কোনো ইচ্ছে নেই তার। একবার পায়চারি করে উঠানের মাঝখানে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে কোনাটায়।
হঠাৎ ভেতরের ঘরে শব্দ বাড়তে লাগলো। অস্থির মুখে সে তাকিয়ে রইলো সেইদিকে। বুকটা তার ধপধপ করছে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে সে একা। এই সন্ধ্যার দিকেও বউটা তার হাসিখুশিই ছিল। রাতে খাবার খেতে বসে হাসতে হাসতে বলছিলো যদি মেয়ে হয় তাহলে নাম রাখবে জোছনাপ্রভা। নামটা খুব সুন্দর কিন্তু রফিকের পছন্দ হয়নি খুব একটা। কেমন যেন কাব্যিক একটা ভাব। এত কাব্যিক নাম ভালো লাগে না রফিকুলের। শিউলি নরসিংদী সরকারি কলেজে বাংলা সাহিত্য নিয়ে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়েছে। রফিকুল কিশোরগঞ্জে একটা স্কুলে ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার পর আর নিয়মিত ক্লাস করা হয়নি। এর মধ্যে কনসিভ করার কারণে তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তার। বিয়ের পর নানা ব্যস্ততার কারণে কোথাও ঘুরতেও যাওয়া হয়নি তাদের। সমুদ্র দেখার খুব শখ শিউলির। হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটা উপন্যাসে না কি জোছনা রাতে সমুদ্রের বর্ণনা আছে। কয়েকবার যাওয়ার কথা বলেও শেষ পর্যন্ত আর সমুদ্রে যাওয়া হয়নি তাদের । এ নিয়ে রাগারাগি,মান -অভিমানও কম হয়নি ওদের।
গত দুইমাসে সে অনেকগুলো কাঁথা সেলাই করে রেখেছে। রফিকুলকে দিয়ে মেয়েদের জামাও কিনে আনিয়েছে কয়েকটি। ওর ধারণা মেয়েই হবে ওদের।
মধ্যরাতের দিকে হঠাৎ পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয় শিউলির। এতো রাতে কী করবে ভেবে পায় না সে। শিউলি তাকে আশ্বস্ত করে- কিছু হবে না দেখিও। এটা সামান্য ব্যাথা। এই সময়ে মাঝে মাঝে এরকম হয়।ডাক্তারতো আরও এক সপ্তাহ পরে তারিখ দিয়েছে। রাতটা কোনরকম কাটুক,সকালে একটা ব্যবস্থা করে হাসপাতালে নিয়ে যেও। শিউলির কথায় ভরসা পায়নি সে। পাশের বাড়ির দুঃসম্পর্কের এক চাচিকে তাড়াতাড়ি ডেকে আনে। চাচিও যখন বলেছে এটা প্রসবের ব্যথা নয়,তখন সে আর কিছু বলেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছিল। আধাঘন্টার মধ্যে যখন ব্যথাটা তীব্র আকার নিল তখন আর উপায়ন্তর না দেখে গ্রামের দাই কারিমা খালাকে ডেকে নিয়ে আসলো সে।
ভেতরের ঘরে এবার উচ্চস্বরে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। রফিকুল আর দেরি না করে দরজায় নক করলো। ভেতর থেকে তার দুঃসম্পর্কের চাচি দরজা খুলেই নাকি স্বরে কাঁদতে কাঁদতে অনর্গল কথা বলে গেল। কী বলছে প্রথমে কিছু বোঝা গেল না। কথার সারমর্ম হলো এই, যে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।
কারো কোনো কথার উত্তর না দিয়েই রফিকুল ছুটে যায় বাজারের দিকে। বাজার বেশি দূরে নয়। দশ মিনিটের পথ। বাজারের পাশেই টেম্পু স্ট্যান্ড। রফিকুলকে ছুটে আসতে দেখে বাজারের পাহারাদার কুতুব আলী দৌড়ে আসে। সব শুনে কুতুব আলী তাকে নিয়ে টেম্পু স্ট্যান্ড এ আসে। টেম্পো স্ট্যান্ডে কোনো কিছুই পাওয়া পাওয়া গেলো না। সব শেষে কুতুব আলী বাজারের রিকশার গ্যারেজ থেকে ভ্যানচালক রবিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রফিকুলের সাথে পাঠায়।
শিউলী এরই মধ্যে দুইবার জ্ঞান হারিয়েছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর। রফিকুল দ্রুত তাকে ভ্যানে শুইয়ে দিয়ে উপজেলা হাসপাতালের উদ্দেশে চলে।
বাইরে তখন জোছনার আলো ম্লান হয়ে এসেছে। দূরের আকাশে দুয়েকটা তারা জ্বলজ্বল করছে। শিউলীর একটা হাত রফিকুল শক্ত করে ধরে আছে নিজের হাতের মুঠোয়। চোখ দুটো নোনা জলে ভিজে আছে তার। আর মনে মনে বলছে- শিউলি, তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে এবার আমরা সত্যিই সমুদ্র দেখতে যাব। আর মেয়ে হলে নাম জোছনাপ্রভাই রাখব।