জাফর সাদেকের একগুচ্ছ কবিতা
(১)
দম-যোগিনীর তাল
জাফর সাদেক
তিনবার চেষ্টায় ঘর ছাড়তে না পারলে আর হয় না
গৃহত্যাগ
কবিতার তাল-যোগী ভেতরে ভেতরে দেশান্তর
প্রথমবার ঘর ছাড়লাম, ডাক দম-যোগিনীর আখড়ায়
আল্লারদরগার এই সন্ন্যাসিনী নৃত্যে হাসে, দেহে ভাবায়
কলকির দমে দমে বলে- আমিই আল্লাহ
আমরাও তার সাথে দমে বলি- তুই আল্লা, তুই আল্লাহ
তেরোতম আখড়াযামিনী কাটানোর পর মনে হলো
যাক প্রথমবারেই গৃহত্যাগ সফল
রাতে সবাই ঘুমে, বললো যোগিনী- ” ঘুমাবি নে আজ
আল্লাহকে পাবি…আনালহক, নে হাত-পা টিপে দে.. আনালহক ”
– খোদা শরীরী নয়, ব্যথার কাহনে কেন চাস অতল দহন
এই বলে- ভোরের খোঁজে দিলাম জানপ্রাণ দৌড়
ঘরে ফিরে দেখি মারা গেছে পোষা আদুরে বেড়াল
দ্বিতীয়বার ঘর ছাড়লাম…
অন্নপূর্ণায় পোঁছে, হা তাকিয়ে আছি এভারেস্ট চুম্বনে
আহা একাকিত্ব কতবড় ঐশ্বর্য জানে ওই মহান সন্ন্যাস
শীতের কাঁপন, বেজক্যাম্পের ভেতর খড়ির আগুন
মনে হচ্ছিলো নিজঘরে শিশুকন্যার নূপুর কিন্নর
বা তাকে জড়িয়ে যে-উত্তাপ, তা এই আগুনে নেই…
তৃতীয়বার…না থাক, অসফল আর কিছু বর্ণন নয়..
কবিতার তাল-যোগী ভেতরে ভেতরে দেশান্তর
কবিতার দম-যোগী অন্তরে অন্তরে দেশান্তর
[কবিতাগ্রন্থ: ‘দম-যোগিনীর তাল]
(২)
একা এক দারুগাছ
জাফর সাদেক
বেড়ে উঠি হাত ছাড়িয়ে সাড়ে-তিন হাত
যেহেতু জন্মের কাছে জবাবদিহি নেই পিতামাতার
হামা থেকে বেড়ে ওঠার জন্য রয়ে গেছে ফাঁসজাল
একের পর এক সেই জাল কেটে কেটে এগিয়ে যাই
জনম জড়িয়ে গেছে পথহারা মায়াজালে, কান পাতি
যেহেতু আবারও তোমার উষ্ণতা পেতে দিতে হবে পাড়ি
দগদগে স্মৃতিদাগ
স্পর্শ, চুম্বন,অগ্নিরাত এগুলো সম্পর্কের নকশাকার
কিন্তু ইন্দ্রজাল… আজীবন জড়িয়ে অহেতুক মায়াপথ
যেহেতু মায়াজাল ছিঁড়ে আমরা চলে গেছি বিপরীত রেখায়
নদী পেরিয়ে, স্নান এড়িয়ে, দূরে দেখা যায় চাঁদ-কোলাহল
হাঁটছি একা—আগে রাসপূর্ণিমার ঢল—পথ ফুল মহুয়ার মল
হাঁটছি একা এক দারুগাছ
[কবিতাগ্রন্থ: ‘একা এক দারুগাছ ‘]
(৩)
কাকের জন্যই
ময়ূরীর নাম প্রথম জেনেছি হৃদয়
ময়ূরের সাথে তুলনায় কৃত্রিমতা বা পতনের ইঙ্গিত দেয় মানুষ
কাক যদি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারতো
ময়ূর আছে তার সুন্দরে আর সে শুধু নিজ কর্মগুণে
তবে তার চোখে থাকতো চপলা মেঘের চাহনি
নিজ পুচ্ছদেশ ফেলে দেবার ইচ্ছা না করে– একজীবন
স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় চেয়ে নিতো তম্বি এক পাহাড়ি নদী
মনস্তাত্ত্বিকভাবে ময়ূরও তাই– সে
মেঘের প্রসবে, বৃষ্টির চিৎকারে, সঙ্গীর খোঁজে নেচে নেচে
দেহে নামায় এক পৃথিবীর সব রং– সে কী জানে
এমন সুন্দরে প্রেমিকা খোঁজে আত্মহননের পথ
দিল্লির লোদি গার্ডেনে দেখেছি ময়ূরীর পাশে হাঁটছে কাক
পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং বটবৃক্ষের জনক হচ্ছে কাক, আর
ময়ূর চলন্ত গোলাপ বাগান
ভাবছিলাম– যার আছে সে জানে তার কিছুই নেই
[কবিতাগ্রন্থ : একা এক দারুগাছ]
(৪)
ভুল–ডাকপিয়ন
জাফর সাদেক
তরুণী জানতো ভীষণ খেয়ালি হেমন্তের শিশির
শীতের আগে ফোটাবে মথুরাফুল
তার জানালায়, সন্ধে একঝাঁক তারায় আসবে
পথের ইশারা শেখাতে
কোথাও রাতের বন্দনা নিয়ে গাইবে প্রেমিক ডাহুক
তখন মেলে ধরবে সে বুকের ভেতরের শিউলিগাছ
বিকেলের সূর্য সরিয়ে হৃদয়ে লালিত পুকুরে ভাসবে
লজ্জার পূর্বরাগ
তরুণীর একবার বন্দনার পরিবর্তে
উড়াল ওড়নায় চাইলো বেদনা নির্ভর সুখ
তার দুয়ারে এবার এক আকাশ মেঘ
সব প্রসবী মেঘে হয়না বৃষ্টির বৈশালি কূজন
বজ্রের ঘরে রেখে আসতে হয় শরীরের রক্তাক্ত অলিগলি পথ
জানি, তরুণী খণ্ড খণ্ড হতে রোজ চিঠি দেয় বজ্রের কাছে
আমি কিন্তু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করি— ভুল–ডাকপিয়ন
(৫)
মানসীর সন্ধে
জাফর সাদেক
মানসীর মা আসতে দিতো না ওকে নদীঘাট
পৌষের সন্ধে যে
রাতের কাছ হতে ধার করা অলঙ্কার
সাঁজগোজের আয়নায় দাঁড়ানোর আগেই নিয়ে নেয়
মানসী জানতো যে-মাঝি পারাপার শিখেছে
তার কাছে সন্ধে পুরানো ডায়েরির মতো
হঠাৎ স্মরণ করাতে পারে ভুলে থাকা নাভিপদ্ম
মানসীর বড়দিদি বিধবা হবার পর
কেন জানি দিদির জন্য বাধা হলো না খেয়াঘাট, তারপর
থেকে প্রতি শীতে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস
মানসী কেবল জানতো না
যে-মাঝি নৌকোর গলুইয়ে সাঁঝ নিয়ে রাত হয়
ভোর হয়
সে একদিন হাঁসের উড়াল ডানায় বেধে দেবে
বড়দি’র শাড়ির আঁচল
আগামি শীতে আসবে নতুন অতিথি পাখির দল